- Home
- সরল থেকে সরলতর, বিস্ময়ের চেয়ে বিস্ময়কর!!
পানি (H2O), হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণু ও অক্সিজেনের একটি পরমাণুর সমন্বয়েই যৌগটির গঠন। স্কুলজীবনে সম্ভবত এটাই আমাদের শেখা প্রথম রাসায়নিক সংকেত। পানির আরেকটি সুন্দর নাম জীবন, কিন্তু কখনও কি চিন্তা করেছেন কেন এর নাম জীবন রাখা হয়েছে? অথবা ধরুন হঠাৎ একদিন পৃথিবী থেকে সমস্ত পানি উধাও হয়ে গেলো!
সমুদ্রে পানির বদলে লবনের স্তূপ, মহাসাগরের গভীরে থাকা বিশাল বিশাল আগ্নেয়গিরি ও গর্তগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নেই কোন ঝর্না, খাল বা নদী, নেই ঝোপঝাড়, গাছপালা অথবা সবুজের কোন চিহ্ন। যেদিকেই চোখ যায়, শুধু শুকনো বালু আর পাথর। চিরচেনা সেই নীল আকাশটিও লাগবে অদ্ভুত, মেঘহীন তার রং ও রূপ কেমন যেন অচেনা ও ভয়ংকর!! অসাড়, প্রাণহীন আমাদের এই পৃথিবীটা অন্যরকম দেখতে। কি কল্পনা করেই গা শিউরে উঠছে??
কি সরল একটা যৌগ কিন্তু এরই অভাবে জীব, জড় বুদ্ধিমান নির্বোধ সকল জীবনই অচল। এমনটি কেনই বা হয়, চলুন দেখে আসি…
বিজ্ঞানী সেলসিয়াস যখন তাপমাত্রা পরিমাপের যন্ত্র আবিষ্কার করেন, তখন তার ভিত্তিস্বরূপ দুটি মান/ধ্রুবক ঠিক করেন। প্রথমটি পানির হিমাংক ও দ্বিতীয়টি পানির স্ফুটনাংক। হিমাংক ০ ডিগ্রি এবং স্ফুটনাংক ১০০ ডিগ্রি এর সমান ধরে তিনি এর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে ১০০ ভাগে ভাগ করলেন। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল তাপমাত্রা পরিমাপকের প্রথম যন্ত্র যেটিকে আমরা থার্মোমিটার নামে চিনি।
কিন্তু বিজ্ঞানী সেলসিয়াস যদি জানতেন, পানি আসলে ০ ডিগ্রিতে জমে না আর ১০০ ডিগ্রিতেও ফুটেনা, তাহলে কিরকম হত?? এখনকার বিজ্ঞানীরা জানেন যে পানি এ ব্যাপারে প্রথম প্রবঞ্চক। পানিই পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যাতিক্রমধর্মী যৌগ। কারন, বিজ্ঞানীদের দাবি, পানির স্ফুটনাংক হউয়া উচিত -৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পর্যায়বৃত্তের নিয়ম অনুসারে পানির মেরুদেশীয় তাপমাত্রাতেই ফোটার কথা।
পর্যায়সারণীর যেকোনো দলভুক্ত মৌলসমূহ ভর অনুসারে হালকা থেকে ভারি পর্যায়ে ক্রমবিন্যস্ত। এর দৃষ্টান্তসরূপ স্ফুটনাংকও উল্লেখ্য। মেন্ডেলিভের পর্যায়সারণী অনুসারে প্রতিটি যৌগের অণুতে অন্তর্গত মৌলসমূহের অবস্থানের উপর তার ধর্ম নির্ভরশীল। হাইড্রোজেন যৌগ হিসেবে একই দলের হাইড্রাইডভুক্ত মৌল সম্পর্কে নিয়মটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
পানিকে ডাই হাইড্রোজেন অক্সাইড বা অক্সিজেন হাইড্রাইড বলা হয়। অক্সিজেন পর্যায় সারণীর ৬ষ্ঠ গ্রুপের অন্তর্গত যে গ্রুপে সালফার, সেলেনিয়াম, টেলুরিয়াম ও পোলোনিয়াম বিদ্যমান। এই সকল মৌলের হাইড্রাইডগুলির আণবিক কাঠামো কিন্তু পানির মতইঃ H2S, H2Se, H2Te এবং H2Po. এদের স্ফুটনাংক সালফার থেকে শুরু করে পর্যায়সারণীর অনুসারে নির্দিষ্টভাবে ক্রমবিন্যস্ত। কিন্তু গো ধরে বসল শুধুমাত্র এই পানি!! পানির স্ফুটনাংক এই ধারার এক অভাবনীয় ব্যাতিক্রম এবং প্রত্যাশিত মাত্রা থেকে অনেক বেশি। পর্যায়সারণীর নির্ধারিত নীতিমালা মানতে গেলে যে তাকে -৮০ ডিগ্রিতে বাষ্পীভূত হবে যেটা সে কোনভাবেই মানতে নারাজ। এটি পানির বিস্ময়কর এবং ব্যাতিক্রমী অনেকগুলো ধর্মের মধ্যে একটি ধর্ম মাত্র!!
এবার আসা যাক পানির দ্বিতীয় ব্যাতিক্রমী ধর্মে, এর হিমাংকে। পর্যায়সারণীর নিয়ম অনুযায়ী তার কিন্তু -১০০ ডিগ্রিতে বরফ হওয়ার কথা কিন্তু সে কিনা ০ ডিগ্রিতেই বরফে রূপ নেয়!
পানির এইরকম একগুঁয়েমি স্বভাব পৃথিবীতে তার তরল ও কঠিন অবস্থার অস্বাভাবিকতাকেই দিনশেষে প্রতিষ্ঠিত করে। আসল নিয়ম অনুসারে এই গ্রহে পানির অস্তিত্ব বাষ্পীয় রূপে দেখার কথা ছিল আমাদের।
এখন আসুন এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করি যেখানে পানি তার পর্যায়সারণীর পর্যায়বৃত্ত ধর্ম মেনে চলে… কোন একটি লেখকের মাথায় এই আইডিয়া টা আসলে আমি সিওর সে পুরদম এ একটি Sci-fi থ্রিলার গল্প লিখে ফেলবেন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীদের জন্য ব্যাপারটি একদমই অবাস্তব এবং অসম্ভব কারন তারা অনেক আগেই মেনে নিয়েছেন যে পানি তার ধর্ম মেনে চলবেইনা এবং এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং পর্যায়সারণীকে প্রথম দৃষ্টিতে দেখে যা ই মনে হোক না কেন তা আসলে অনেক জটিল এবং এর বাসিন্দারাও আমাদের মত অনেক জীবিত মানুষের মতই রুলস/নিয়ম মানতে নারাজ। পানিকে তাই ক্লাসের কোন দুষ্টু ছেলে হিসেবে ভাবলেও ভুল কিছু হবেনা আশা করছি!
কিন্তু কেন সে এত দুষ্ট, কেন সে মানেনা নিয়ম?
কারন পানির অণুর একটি বিশেষ বিন্যাস আছে যার কারনে পরস্পরকে প্রকটভাবে আকর্ষণ করার ক্ষমতাটি ও তার আছে। তাইতো পানির একক অনুকে গ্লাসে খুজতে যাওয়া বৃথা। তার অণুগুলো দলবদ্ধ অবস্থায় থাকে যাকে বিজ্ঞানীরা পলিমার বলে। আর সেজন্যই পানির সংকেত লিখার শুদ্ধ পদ্ধতি হচ্ছে (H2O)n; এখানে n পলিমারে পানির অণুর সংখ্যার প্রতীক।
পানির অণুগুলো পলিমার অবস্থায় থাকার কারনে এটিকে হঠাৎ করেই ভেঙে ফেলা যায়না, তাই প্রত্যাশিত তাপমাত্রা থেকে অনেক বেশি তাপমাত্রায় এটি জমে/বরফ হয় এবং বাষ্পীভূত হয়।
দুষ্টুচরিত্রের এই পানিকে নিয়ে লেখা শুরু করলে আসলে এক দিনে শেষ হওয়ার নয়, তাই আজকে তার একটি ধর্ম নিয়েই লিখলাম, পানির আরও দুষ্টু সব চরিত্র সম্পর্কে জানতে চোখ রাখুন আমাদের পরবর্তী ব্লগ গুলোতে।